Photo: Stephen C Dickson, Wikimedia Commons
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং সংযুক্ত করার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় তৈরি এ ওয়েবসাইটটির পেজ গত ১২ মাসে ১ লাখেরও বেশি ভিউ হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সর্বোত্তম চর্চা, প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং দিকনির্দেশনার প্রতি আগ্রহ ও চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে।
ডেভিড ব্রিউয়ার, মিডিয়া হেল্পিং মিডিয়া এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক এ তথ্যটি জানান।
২০১৭ সালে সিওলে গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক (জিআইজেএন)-এর আয়োজিত এক সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন মিরাজ আহমেদ চৌধুরী। তখন তিনি জানতেনও না, একদিন তিনি জিআইজেএন এর বাংলা ওয়েবসাইটের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
এক তাৎক্ষণিক আলোচনায় জিআইজেএন-এর নির্বাহী পরিচালক ডেভিড ক্যাপলানের সঙ্গে মিরাজ আহমেদ চৌধুরীর কথাবার্তা শুরু হয়। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এ জনপ্রিয় ওয়েবসাইটটি। এটি এখন বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জন্য গভীর ও শক্তিশালী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ভান্ডার হয়ে উঠেছে।
সাংবাদিকতায় ১৪ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চৌধুরী, ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশের ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এমআরডিআই)-এর প্রোগ্রাম ও যোগাযোগ বিভাগের প্রধান হিসেবে।
ফোয়ো মিডিয়া ইনস্টিটিউটের আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষকদের পরিচালনায় গত সাড়ে তিন বছর ধরে তিনি ঢাকায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও অন্যান্য গণমাধ্যম বিষয়ক প্রশিক্ষণ আয়োজন ও তদারকি করে আসছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জিআইজেএন-এর রিসোর্স ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে ক্যাপলানের আগ্রহ এবং চৌধুরীর অভিজ্ঞতা এই দুইয়ের সমন্বয়েই সিদ্ধান্ত হয় সংগঠনটির ১০ম ভাষাভিত্তিক ওয়েবসাইট চালুর। সেই উদ্যোগের ফলাফলই হচ্ছে জিআইজেএন বাংলা।
Screenshot of GIJN Bangla taken November 2020
চৌধুরীর মতে, ২০১৮ সালে চালু হওয়া এই সাইটটির লক্ষ্য হলো, “বাংলাভাষী সাংবাদিকরা যেন আন্তর্জাতিক জ্ঞান ও তথ্যের সুফল নিতে পারেন, এবং বিশ্বের অন্য প্রান্তের মানুষদের কাছে বাংলাদেশের সেরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার গল্প তুলে ধরতে পারেন।”
দুই বছর পর, জিআইজেএন-এর ১৩০টি দেশের বৈশ্বিক কার্যক্রমের মধ্যে ৪৩,০০০ ইউনিক ভিজিটসহ বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। এবং ওয়েবসাইট ভিজিটে গত বছরের তুলনায় এবার দর্শনার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০%।
ক্যাপলান বলেন, বাংলাদেশে ফোয়ো ও এমআরডিআই-এর র্অজন “জাতীয় পর্যায়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে সহায়তা করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার একটি সাফল্যের গল্প।” তিনি আরও বলেন, “জিআইজেএন বাংলা-সহ তাদের উদ্যোগ সাংবাদিকতা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে এগিয়ে নিয়েছে, আধুনিক সরঞ্জাম ও কৌশলের প্রসার ঘটিয়েছে, এবং দেশে নজরদারি সাংবাদিকতাকে আরও শক্তিশালী করেছে।”
তিনি বলেন, জিআইজেএন-এর এই সংযোগ “অনলাইন নেটওয়ার্ক, ফেলোশিপ, ওয়েবিনারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাভাষী সাংবাদিকদের বিশ্বব্যাপী অনুসন্ধানী প্রতিবেদকদের কমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত করেছে।”
প্রথম আলোর স্পেশাল নিউজ এডিটর কুররাতুল-আইন-তাহমিনা জানান, তাদের পত্রিকার কয়েকজন রিপোর্টার নিয়মিত জিআইজেএন বাংলা ব্যবহার করেন। তিনি আরও বলেন, অন্য অনেক সংবাদমাধ্যমে কাজ করা রিপোর্টারদেরও তিনি চেনেন, যারা প্রয়োজনে জিআইজেএন-এর হেল্পডেস্কে যোগাযোগ করে সাহায্য পেয়েছেন। তাহমিনা বলেন, “ওদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটা বেশ গুছানো, সবাই খুব দ্রুত রেসপন্স করে আর যেসব কনটেন্ট শেয়ার করে, সেগুলো খুব সুনির্দিষ্ট আর র্কাযকর। ভালো লাগে যে এখানে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলো আগ্রহী অনুসন্ধানী সাংবাদিকরাই বাছাই করে শেয়ার করেন। আর যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- সব কিছুই বাংলায়, যেটা আমাদের মতো সাংবাদিকদের জন্য অনেক বড় একটা সুবিধা।”
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল আর দ্য গার্ডিয়ান-সহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মাধ্যমে লেখালেখি করেন এমন একজন বাংলাদেশি অনুসন্ধানী সাংবাদিক সৈয়দ জাইন আল-মাহমুদ বলেন, তিনি বেশ কয়েকবার জিআইজেএন বাংলা ভিজিট করেছেন। তিনি বলেন, “সাইটটা দারুণ, কিন্তু আরও প্রভাব ফেলতে হলে বাংলাদেশ নিয়ে আরও বেশি কনটেন্ট দরকার। আমাদের বাস্তবতা বুঝে, আমাদের প্রেক্ষাপটে সাজানো কনটেন্ট থাকলে অনেক বেশি কাজে লাগবে।”
চৌধুরী ধারনা জানেন, জিআইজেএন বাংলার প্রভাব আর পরিধি বাড়ানোর জন্য এখনো অনেক কিছু করা বাকি। সেকারণে তিনি আর তাঁর টিম এখন জোর দিচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ার উপর।
জিআইজেএন বাংলার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এখন সদস্য সংখা ২১৭, যেটা গ্রুপের সর্বোচ্চ সীমা। আর এই সংখ্যাটা পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে! সদস্যদের বেশিরভাগই অভিজ্ঞ বা সিনিয়র সাংবাদিক। শুরুতে গ্রুপে রোজ নতুন আপডেট যেত, এখন সেটা হয় সপ্তাহে তিন-চারবার।
জিআইজেএন বাংলা’র ফেসবুক পেজে এখন ৫,০০০-এর বেশি লাইক আছে। ফলোয়ারদের মধ্যে বেশিরভাগই সাংবাদিক, তবে কিছু সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রছাত্রীও আছেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকও আছেন, যারা ক্লাসে জিআইজেএন বাংলার কনটেন্ট ব্যবহার করেন শেখানোর জন্য।
ভারতে জিআইজেএন বাংলা’র জনপ্রিয়তা দেখে চৌধুরী বিশেষভাবে উৎসাহিত। তিনি বলেন, বাংলাভাষী রাজ্যগুলো থেকে ভিজিটরের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। গুগল অ্যানালিটিক্স-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে কলকাতা থেকে ভিজিট পাঁচ গুণ বেড়েছে। এমনকি আসাম থেকেও অনেক বেশি ভিজিট এসেছে, “যে রাজ্যগুলো সাধারণভাবে বেশি শিক্ষিত ও প্রগতিশীল হিসেবে বিবেচিত, তাদের চেয়েও।”
চৌধুরীর করা কোভিড নিয়ে কিছু লেখা ব্যতীত, জিআইজেএন বাংলা নিজে কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করে না। তিনি বলেন, “এই সাইটটা একটা জ্ঞানভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারেন। সবাই মিলে কাজের টুলস আর কৌশল শেয়ার করে একে অপরকে সহায়তা করেন।”
এই জ্ঞানের আদান-প্রদান এবং পারস্পরিক আস্থা বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে কাজ করতে গিয়ে তাদের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। দেশের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ) অনুযায়ী সাংবাদিকদের খুব সতর্ক থাকতে হয়, যেন আইন লঙ্ঘন না হয়। চৌধুরীর মতে, এই পরিস্থিতি অনেক সময় স্ব-আরোপতি সেন্সর-এর দিকে ঠেলে দেয় যা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের সরকারের সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল থেকে নেওয়া অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের অক্টোবরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) কার্যকর হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২,০০০ মামলা দায়ের হয়েছে। ঠিক সেই সময়েই জিআইজেএন বাংলা তাদের যাত্রা শুরু করে।
অ্যামনেস্টি বলছে, ২০২০ সালের শুরু থেকে মাত্র ৯ মাসের মধ্যেই ৮০০-র বেশি মামলা হয়েছে। আর, এর অনেকগুলোই করা হয়েছে দেশের পরিচিত সব সম্পাদক আর সিনিয়র সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অর্থাৎ তাদেরকেই টার্গেট করে।
“হাব” নামে জিআইজেএন-এর একটা হেল্পলাইন আছে। সাংবাদিকরা যদি কোনো সাহায্য বা গাইডলাইন চান, তাহলে সেখানেই সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন। শুধু গত ১০ মাসেই বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬০টা কল গেছে সেখানে। চৌধুরী বললেন, এটা থেকেই বোঝা যায় জিআইজেএন বাংলা একদম ঠিক সময়েই শুরু হয়েছে। মানুষ এটা কাজে লাগাচ্ছে, প্রয়োজনীয় মনে করছে। আর আর অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সহায়তা করার যে উদ্দেশ্যে এটা তৈরি হয়েছিল সেটা ভালোভাবেই কাজ করছে।
ফোয়ো মিডিয়া ইনস্টিটিউটের নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগের প্রধান লার্স টালার্ট জানান, জিআইজেএন বাংলা এর উদ্যোগ তাদের এতোটাই অনুপ্রাণিত করেছে যে তারা এখন আফ্রিকাতেও এই মডেলটা চালু করতে চান। তার ভাষায়, “ জিআইজেএন বাংলার সফলতা দেখে ফোয়ো মিডিয়া ইনস্টিটিউট সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, উগান্ডায় জিআইজেএন ইস্ট আফ্রিকা আর সেনেগালে জিআইজেএন ওয়েস্ট আফ্রিকাকে আমাদের পার্টনারদের সঙ্গে মিলে সাপোর্ট করব।” ।” লার্স আশা প্রকাশ করেন, আফ্রিকার ইস্ট আর ওয়েস্ট দুই জায়গাতেই এই নতুন উদ্যোগগুলো জিআইজেএন বাংলার মতো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।